বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ বলেছেন ‘মাদার অব হিপোক্রেসী’ শেখ হাসিনা বিগত ১৫ বছর ধরে মানবাধিকার আর ভোটাধিকার হরণের মাধ্যমে জগদ্দল পাথরের মত জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। হাসিনা ও তার সামরিক-বেসামরিক সাঙ্গপাঙ্গদের সৃষ্ট ‘আয়না ঘর’ এখন মানবতার হস্তারক সেল হিসাবে কুখ্যাতি পেয়েছে। আয়নাঘরে পরিচালিত নিষ্ঠুরতার বর্ণনা হিটলারের গ্যাস চেম্বার আর গেষ্টাপো বাহিনীর নির্মমতাকে হার মানিয়েছে।

শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, চট্টগ্রাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পেশাজীবী নেতা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন—সিএমইউজে সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ লিখিত বক্তব্যে এসব বলেন। সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি ও দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান জাহিদুল করিম কচি।

লিখত বক্তব্যে সিএমইউজে সভাপতি মোহাম্মদ শাহনওয়াজ বলেন, হাসিনার সরকার মেগা প্রজেক্ট, মেগা করাপশন আর মেগা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও অর্থনীতিকে এক দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে গেছে। গণতন্ত্র আর মানবাধিকারকে নির্বাসনে পাঠিয়ে উন্নয়ন আর মুজিববাদের বডি গেলানোকে স্বাধীনতা ভাবতে তারা। কারাগারে শিকলবন্দী মানুষজনকে বিনামূল্যে সস্তা খাবার দিয়ে কোনো মতে বাঁচিয়ে রাখার অপকৌশল হিসেবে দেখেছে। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল পৃথিবীর অন্যতম নিকৃষ্ট ফ্যাসিবাদী রেজিমের কুখ্যাতি অর্জন করেছে। শিক্ষক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, আলেম-ওলামাসহ কোনো শ্রেণী পেশার মানুষই তার অপমান আর নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাননি।

ফ্যাসিবাদী হাসিনার পতন পরবর্তী সাময়িক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে দেশী-বিদেশী রাষ্ট্রঘাতি এজেন্টরা বিপ্লবের অর্জন নস্যাৎ করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্রের জাল পেতে চলছে। কখনো সংখ্যালঘু, কখনো জুডিসিয়াল ক্যু, কখনো আনসার হট্টগোল, প্রতিবেশী ভারত কর্তৃক বিনা নোটিশে পানি ছেড়ে দিয়ে প্রলয়ংকারী বন্যা, কখনো উত্তর পাড়ায় গন্ডগোলের গুজব ছড়ানো, সর্বশেষ শিল্পাঞ্চালে বহিরাগতদের দিয়ে শ্রমিক অসন্তোষ ও রপ্তানীমূখী কারখানায় ধবংসাত্বক কার্যকলাপ চালানোর মাধ্যমে তথাকথিত প্রতি বিপ্লবের দুঃস্বপ্ন দেখছে।

আমরা পেশাজীবীরা সুস্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে শুধু বিপ্লবী ছাত্র সমাজ নয়, পুরো দেশ প্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি আর সর্বস্তরের জনগণ তাদের হৃদয় নিংড়ানো সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ, পতিত ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান কিংবা পূর্ণবাসনের যে কোনো উদ্ধত্য দেশবাসী প্রয়োজনে পূর্নবার মরণপন লড়াইয়ের মাধ্যমে পরাজিত করবেই।

জুলাই-আগস্টের মহাবিপ্লবের টর্নেডোতে ছত্রখান হয়েছে হাসিনার স্বৈরাচারের তাসের ঘর। কোমলমতি ছাত্র- ছাত্রীদের মরণঘাতি মরণাস্ত্রের সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় বুক পেতে গৌরবময় মৃত্যু আলিঙ্গনের বীরত্বগাঁথা সমসমায়িক বিশ্ব ইতিহাস বিরল। এমন অমিততেজ সাহস আর দেশপ্রেম থেকে সংঘটিত বিপ্লব ১৯৭১ এর পর বাংলাদেশ ও তার মানুষের সামনে পুনরায় এনে দিয়েছে মুক্তির মহাসোপান। বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত, ফ্যাসিবাদমুক্ত একটি মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমের শহীদী স্বপ্ন বাকী মানুষের আকাঙ্খাকে জোরদার করেছে।

এই স্বপ্ন আকাঙ্খার আলোকে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, চট্টগ্রাম শাখা থেকে নিমোক্ত প্রস্তাবনাসমূহ জাতির সামনে হাজির করছি।

১. বিভিন্ন পেশার বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিত্ব ও বিদগ্ধজনদের সমন্বয়ে একটি ‘জাতীয় সংস্কার কমিশন’ গঠন করে তার সুপারিশনামার আলোকে সংবিধান, বিচার বিভাগ, প্রশাসন সহ সর্বস্তরে একটি মৌলিক সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ।

২. বিগত ১৫ বছর ধরে গুম, খুনে জড়িতদের এবং সর্বশেষ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মানবতা বিরোধী গণহত্যার পরিকল্পনাকারী, আদেশদাতা ও হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা।

৩. প্রশাসন, বিচার বিভাগ, সংবাদ মাধ্যম সহ রাষ্ট্র আর তার সহযোগী অর্গানসমূহে ১৫ বছর ধরে ফ্যাসিবাদ কায়েম আর দুর্নীতির হোতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিগত দিনে জেল, জুলুম আর চাকুরিচ্যুতির কারণে অমানবিক পরিস্থিতি শিকার ব্যক্তিবর্গকে সসম্মানে পূনর্বহাল ও ক্ষতিপূরণ প্রদান। কারণ আমরা মনে করি, গত ১৫ বছর ধরে হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল ও শক্তি সমূহের অবর্ণনীয় ত্যাগ ও সংগ্রামে সৃষ্ট পটভূমিতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরিচালিত কোটা সংস্কার থেকে ১ দফা আন্দোলনে শক্তি সঞ্চার আর অগণিত জনতার সমর্থন পেয়েছে। তাই পূর্বাপরের এ সম্পূরক লড়াইয়ের ত্যাগ স্বীকার যাঁরা করেছেন তাদেরও সমানভাবে মূল্যায়ন করা উচিত।

৪. বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ পরিবারের অর্থনৈতিক দায়িত্বভার রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে আনয়ন, আহত, পঙ্গুত্ববরণকারীদের উন্নত চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ।

৫. ব্যাংকখাতে লুটপাট আর লক্ষকোটি টাকা পাচারকারী রাজনীতিবিদ, আমলা আর হাসিনার সহযোগী ব্যবসায়ি কর্পোরেট হাউজগুলোর কর্ণধারদের শাস্তি নিশ্চিত, সম্পদ বাজেয়াপ্ত, পাচারকৃত টাকা ফেরত আনার জন্য দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।

৬. দুঃশাসনের দূর্গ হিসাবে কুখ্যাত গণভবনকে ‘জুলাই ছাত্র গণঅভ্যুত্থান স্মৃতি যাদুঘর’ হিসাবে প্রতিষ্ঠার সরকারী সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি। একইসাথে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে প্রদর্শিত বীরত্বগাঁথা, পটভূমি, ভালোবাসা ও নিষ্ঠুরতা, শ্লোগান-গ্লাফিতি, আন্দোলনের সঞ্জিবনী শক্তি হিসাবে ব্যবহৃত শ্লোগান, সংগীত, ছাত্রী-মহিলাদের সাহসী উচ্চারণ আর অংশগ্রহণ সবকিছুকে উপজীব্য করে ডকুমেন্টারী, নাটক, সিনেমা, গান সহ গবেষণাধর্মী প্রকাশনায় রাষ্ট্রেয় পৃষ্টাপোষকতা প্রদান।

৭. দুর্নীতি আর লুটপাটের ‘প্রটেকশন আমব্রেলা’ হিসাবে খ্যাত কর্পোরেট মিডিয়া হাউজ ভেঙ্গে দিয়ে “এক মালিক-এক গণমাধ্যম” নীতিমালা প্রণয়ন সহ গণমাধ্যমের সার্বিক পেশাদারিত্ব, গণতন্ত্রায়ন ও সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন, সাবেক সভাপতি এনামুল হক, চবি জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নসরুল কদির, এ্যাবের বিভাগীয় সভাপতি প্রকৌশলী সেলিম জানে আলম, ড্যাব নেতা ডা. আব্বাস উদ্দীন, ডা. হারুন রশীদ, আইনজীবী নেতা অ্যাডভোকেট মফিজুল হক ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট হাসান আলী চৌধুরী প্রমূখ।

আরও খবর